Thursday, 9 April 2015

KOLKATA (ALSO KNOWN AS CALCUTTA)

        কলকাতার ভাগ্যটা বড় অদভুত।  আমরা  এর বুকে বাস করি ,  একে  ভালবাসি,আদর  করি ,এর জন্যে গর্ববোধ করি। আবার ,আমরাই একে অপমান করি। আমরাই মালা পরাই ,আমরাই কাঁটায় বিদ্ধ করি।


        শহরটার  বয়েস ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে সেই কবে !  ১৪৯৫তে লেখা 'মনসা বিজয়' কাব্যে কলিকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ মধ্যযুগে এ  শহরের অস্তিত্ব প্রমানিত। কিন্তু এক অজানা কারণে কলকাতার কিছু মানুষ দিনের পর দিন সাহিত্যে,চলচ্চিত্রে,স্কুল পাঠ্যে প্রচার করে গেছেন ,১৬৯০তে জব চার্নকের হাতে কলকাতার জন্ম।  একটা সুপ্রাচীন শহরকে ৩০০ বছরের লেবেল লাগিয়ে, নিজেদের গৌরবের ইতিহাসকে অস্বীকার করে তাঁদের কী স্বার্থসিদ্ধি হযেছে , বোঝা কঠিন। 


        কলকাতা নিজের পরিচয় ফিরে পেয়েছে আইনের হাত ধরে। কলকাতা হাই কোর্ট রায় দিয়েছেন , কলকাতার জনক জব চার্নক এবং জন্মদিন ২৪ অগাস্ট ,১৬৯০ --- এ কথা প্রচার করা যাবে না। কারণ , কলকাতার জন্ম তার বহু আগে , সাধারণ মানুষের হাতে। 


       গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। অনেক ঝড়ঝাপটা ,পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পথ চলেছে কলকাতা। এখনো চলছে। বিশ্বের দরবারে তার অনেক পরিচয়। সিনেমার শহর,সাহিত্যের শহর ,সঙ্গীতের শহর ,রাজনীতির শহর। প্রাসাদের শহর। তবে কলকাতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য , তার মানুষ। আমার সাধ্যমত এই সব কিছুর  গল্প বলব। 


       শহিদ মিনার 

       কলকাতার অন্যতম  landmark ৫২ মিটার উঁচু  এই মিনার। নেপাল জয়ের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে ব্রিটিশরা ১৮৩০ সালে এই মিনার তৈরী করেন। তখন নাম ছিল অক্টারলোনি মনুমেন্ট। ১৯৬৯এ নাম হয় শহিদ মিনার।  আগেকার দিনের মানুষদের হিংসে করার একটা কারণ , তাঁরা  শহিদ   মিনারের মাথায় উঠতে পারতেন। বাবা বলে, সে অভিজ্ঞতা ভাষায়  বর্ণনা করা যায় না। এত বড়  শহরটা তার পুরো চেহারা নিয়ে চোখের সামনে হাজির হত । একটা দূরত্বের পর থেকে  সব কেমন ঝাপসা হয়ে যেত। মনে হত ,সমুদ্র যেন এগিয়ে এসেছে।


        শহিদ মিনারের গঠনশৈলীতে তিনটি দেশের প্রভাব লক্ষ্ করা যায়। ভিত্তিভূমি মিশর ,স্তম্ভ সিরিয়া এবং মাথার dome  তুর্কির স্থাপত্য রীতি মেনে তৈরী হযেছে। 


        শহিদ  মিনারের নিচে আছে  কলকাতার বিখ্যাত বাস স্ট্যান্ড ,যেখান থেকে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা , ভিন রাজ্যে,এমন কি ভিন দেশে যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। বর্তমানে পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে বাস স্ট্যান্ডটিকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। 


শহিদ মিনার


         রাণী রাসমণির বাড়ী ,জানবাজার



         রাণী  রাসমণি  ছিলেন আধুনিক,স্বনির্ভর নারীর কালজয়ী উদাহরণ। যখন বিধবা হন ,তখন বয়স ৪৪ বছর। ওই বয়সের এক মহিলার পক্ষে চার দেয়ালের নিরাপদ আশ্রয় থেকে বেরিয়ে আসা আজকের  যুগেও খুব একটা সহজ নয়।  তাহলে উনিশ শতকের রাসমণি  দেবীর পক্ষে কতটা কঠিন ছিল , আন্দাজ করতে কষ্ট হয় না। ব্যবসা ,জমিদারী, বিপুল অর্থ , সম্পত্তি ,পরিবার ,সব কিছুর হাল  ধরেছিলেন  তিনি।  স্বামীর অবর্তমানে জামাইদের সাহায্য নিয়ে যে ভাবে অর্থ ও সম্পত্তি সামলেছেন  এবং  বাড়িয়েছেন ,তা শিক্ষনীয়। অবাক লাগে ,তাঁর কোনো পুঁথিগত শিক্ষা ছিল না। 


        শুধু বিষয় আশয় নিয়েই মেতে থাকেন নি রাণী। কলকাতার উন্নতির জন্যে অনেক কাজ করেছিলেন। রাস্তা তৈরী করেছেন ,গঙ্গার ঘাট সারিয়েছেন। অন্যায় দেখলে কঠোর হাতে দমন করেছেন।   ব্রিটিশ সরকারই  হোক,বা হিন্দু সমাজ, তাঁর কাছে পরাজিত হযেছেন সবাই। জেলে সম্প্রদায়ের মানুষের জন্যে সরকারের সঙ্গে তাঁর বুদ্ধির লড়াই আজ কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছে। 


        দক্ষিনেশ্বরে মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় সমাজের প্রবল বাধার সম্মুখীন হযেছেন। ' শুদ্রের ' মেয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করবে, এ ' অনাচার ' ব্রাহ্মণরা কিছুতেই মেনে নিতে চান নি। ইশ্বরের প্রতি অবিচল ভক্তি রেখে অনেক লড়াইযের পর রাণীমা মন্দির  প্রতিষ্ঠা করলেন। এমন কী ,সে মন্দিরে মা কালীকে  অন্নভোগও দেওয়া হতে লাগলো।কালে  ' নীচু ' জাতের মহিলার মন্দির হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করলো , বাংলার নব জাগরণের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে  উঠলো। 


        এস.এন.ব্যানার্জী রোড ও ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের সংযোগস্থলে রাণী  রাসমণির প্রাসাদ। স্বামী রাজচন্দ্র দাস ২৫ লক্ষ  টাকা খরচ করে এই সাত মহলা বাড়ি বানিয়েছিলেন। সময় লেগেছিল ৮ বছর। বাড়িতে ঘরের সংখ্যা অন্তত ৩০০। ভিতরে পুকুরও  ছিল।  ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের  প্রবেশপথ  দিয়ে ঢুকলেই বিরাট উঠোন। উঠোনের বাঁ  দিকে ঠাকুর দালান। এই দালানে দুর্গাপুজার  সময় একবার উপস্থিত ছিলেন ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেব।  এখানে আজও  পূজা হয়। দালানের ডান  দিকে একটি ছোট্ট  ঘরে ঠাকুর হোম  করেছিলেন। সেই কুন্ডে  আজ মায়ের হোম  হয়।


       উঠোনের বাকি তিন দিকে বারান্দা ও সার বাঁধা ঘর।  এ গুলিতে থাকতেন গৃহশিক্ষক ,পাচক,ভান্ডারী প্রমুখ। আর থাকতেন নিরাপত্তা কর্মীরা। বারান্দায় ঝোলানো থাকত নানা রকমের অস্ত্র। ঠাকুর থাকতেন দোতলার ঘরে। বাড়ির এই অংশটি ছিল বার মহল। আজ রাণীমার ছোট মেয়ের তরফ থাকেন।


       এস.এন.ব্যানার্জী রোড দিয়ে ঢুকলে বাড়ির যে অংশে পৌঁছনো যায় , সেখানে থাকেন মেজ মেয়ের তরফ।  এটি ছিল বাড়ির অন্দর মহল। তাই, বেশ ধোপদুরস্ত। থামের গায়ে আবক্ষ  নারী মূর্তির মোটিফ, চত্বর  শান  বাঁধানো। এই শরিকরাও  দুর্গাপুজা করেন  ।  প্রতিটি মন্ডপেই  কুমারী পূজা হয়।  দুর্গাপুজার  সময় রাণী  রাসমণির বাড়ীর  দরজা সবার জন্যে খোলা।




শ্রী শ্রী ঠাকুরের পদধুলিধন্য সেই ঠাকুর দালান  

মায়ের মূর্তি প্রতি বছর একই রকম। 
মেজ মেয়ের তরফের পুজা 

রাণী রাসমণির এই একটিই ছবি পাওয়া গেছে। 




          

 
শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের হোমকুন্ড 

 

           

         ময়দান 


         তেপান্তরের মাঠের কথা আমরা সবাই জানি। রূপকথার সেই মাঠ এত বড় যে , এদিকে দাঁড়ালে ওদিক দেখা যায় না , মনের আনন্দে তীরবেগে ছুটে চলা যায়,যে দিকে যতদুর খুশি।  কলকাতার  ময়দান সেই তেপান্তরের মাঠ। 


        ১৭৫৮তে  ফোর্ট উইলিয়াম তৈরী করার সময় চৌরঙ্গির পাশে ঘন জঙ্গল সাফ করা হয় এবং জন্ম হয় এক বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তরের। তার নাম গড়ের  মাঠ বা ময়দান। জনবহুল ,ব্যস্ত এলাকার মধ্যে ৪০০ একর -এর মাঠ দেশের আর কোনো মহানগরে নেই।  ময়দানের বুকে রয়েছে  ইডেন গার্ডেন্স , শহিদ  মিনার , ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল , রেস  কোর্স, বিভিন্ন ফুটবল ক্লাবের মাঠ,কলকাতা ইউনিভার্সিটির মাঠ । রয়েছে মনীষীদের  মূর্তি।  কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল দেশের ও বিদেশের নানা জায়গায় যাওয়ার বাসের গুমটি। ময়দানের বুক চিরে তৈরী হয়েছে রেড রোড। সর্বোপরি  রয়েছে  সবুজের সমারোহ। প্রতি মুহূর্তে কলকাতাকে লিটার লিটার অক্সিজেন যোগায়  ময়দান। 


        ময়দানে বসে মানুষ দুদন্ড জিরিয়ে নেয়  , প্রেম করে , শীতের দিনে রোদ্দুর মেখে হুল্লোড়ে  মাতে। এখানে রাজনৈতিক সভা হয় ,সিনেমা-সিরিয়ালের শুটিং হয় , ২৬শে  জানুয়ারির প্যারেড হয়। ঈদ-এর নামাজ রেড রোড -সহ গোটা  এলাকাকে পবিত্র করে দেয়। ময়দান কলকাতার ফুসফুস। 




         
শীতের সকালে ময়দান










ময়দান থেকে চৌরঙ্গী 


       

          ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল 

     
          মহারাণী  ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিরক্ষার্থে লর্ড কার্জনের উদ্যোগে তৈরী হয়েছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। ভিত্তি স্থাপন হয় ১৯০৫এ এবং কাজ শেষ হয়ে জনগনের জন্যে দ্বার উদঘাটন হয়েছিল ১৯২১এ।  এই অপূর্ব স্মৃতিসৌধটির জন্যে শ্বেত পাথর আনা হযেছিল রাজস্থানের মাকরানা থেকে।  গঠনশৈলীতে ইউরোপীয়   ও মুসলিম প্রভাব রয়েছে। প্রবেশপথে রাণী  ভিক্টোরিয়ার ব্রোন্জের  মূর্তি  সমীহ জাগায়।  সামনে,পিছনে ফুলের বাগান চেয়ে থাকার মত। 


          সৌধের মাথায় রয়েছে কালো পরী। আশির দশক পর্যন্ত এই বিশাল মূর্তিটি ঘুরত। এখন স্থির , পরী  আর ঘুরে ঘুরে দশ দিকে নজর রাখে না। 


          ভেতরে রেছে অজস্র ঐতিহাসিক নিদর্শন। প্রাচীন পুঁথি,হাতে আঁকা ছবি , ইতিহাস -প্রসিদ্ধ মানুষদের ব্যবহৃত দ্রব্য ,আরো কত কী। পূর্ব বঙ্গের এক জমিদার-গৃহিণীর  সোনার সুতোর কাজ করা শাড়িটি  অনবদ্য। নিরাপত্তার কারণে সৌধের ভিতরে মোবাইল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে।


          ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কলকাতার অবশ্য দ্রষ্টব্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। 




ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল 




কালো পরী 

        

  
শীতের দুপুরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল 




        রেস  কোর্স      


        ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের পশ্চিম দিকে কলকাতা রেস কোর্স। এটি  ভারতের  বৃহত্তম রেস  কোর্স। স্থাপিত হয়েছিল ১৮২০তে। 



রেস  কোর্স 




         শিয়ালদা স্টেশন 


         গঙ্গার পশ্চিমে রেলপথ চালু হয়েছিল ১৮৫৪তে।  পুবের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থার প্রয়োজন তের পাওয়া যাচ্ছিল। এক বেসরকারী  কোম্পানির উদ্যোগে ১৮৬২তে তৈরী হয় কলকাতা-ক্যানিং রেলপথ। কয়েক মাস পরেই ব্রিটিশ সরকার এই রেলপথ অধিগ্রহণ করেন।  এখন যার নাম শিয়ালদা সাউথ স্টেশন ,তখন  সেটি ছিল বেলিয়াঘাটা  স্টেশন।  সেখান থেকে  ট্রেন ছুটেছিল ক্যানিং-এর দিকে।   অর্থাৎ , এখন শিয়ালদা থেকে যে লাইনটি পার্ক সার্কাস ,বালিগঞ্জ ,ঢাকুরিয়া ,যাদবপুর ,গড়িয়া   হয়ে শহর ছাড়িয়ে চলে গাছে ক্যানিং-এর দিকে , সেটি গঙ্গার পুব  পাড়ের প্রথম রেলপথ। 


        রেল  লাইন বসানোর  সময়  নিচু জমি উঁচু  করার জন্য আশপাশ থেকে এত মাটি  কাটা হয়েছিল ,যে লম্বা লম্বা খাল তৈরী হয়ে গিয়েছিল। আজ সেই সব খাল আর নেই বললেই চলে।  মানুষের প্রয়োজনে তাদের সৃষ্টি  হয়েছিল, মানুষের প্রয়োজনেই ভরাট হতে হতে তারা হারিয়ে গেছে। আজ যাদবপুর,সন্তোষপুর  অঞ্চলে রেল লাইন বরাবর যে সব ঝিল দেখা যায় , সেগুলি অতীতের খালগুলির অবশিষ্ট অংশ। বিবেক নগরের ঝিল এ রকম একটি উদাহরণ। কলকাতা পুরসভা জানাচ্ছে, ঝিলটির বয়স অন্তত ৮০ বছর। এলাকার খুব কম মানুষ জানেন , তাঁদের পাড়ায় ইতিহাসের এ রকম একটি সাক্ষী চুপ করে বসে আছে !


বিবেক নগরের ঝিল


সেই প্রাচীন রেলপথের অংশ ( ঢাকুরিয়া অঞ্চল)


      শিয়ালদা  স্টেশনের মেন ও নর্থ শাখা তৈরী হয় বেশ কয়েক বছর পরে ,১৮৬৯এ। ডায়মন্ড হারবার লাইন চালু হয় ১৮৮৩তে এবং বজ বজ ১৮৯০তে। এই  স্টেশন ভারতের গৌরব এবং লজ্জা , দুই-এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে।

       ১৮৯৭-এর ১৯শে  ফেব্রুয়ারী শিয়ালদা স্টেশন লোকে লোকারণ্য।  প্রায় ২০০০০ মানুষ সাগ্রহে অপেক্ষা করে রয়েছেন। কারণ , স্বামী বিবেকানন্দ চিকাগোতে বিশ্বজয় করে কলকাতা ফিরছেন। জাহাজে করে বজবজ এসে সেখান থেকে ট্রেনে শিয়ালদা নেমেছিলেন স্বামীজি। হর্ষধ্বনিতে মুখর  হয়েছিল চারিদিক।


       আবার , দেশভাগের মত কলঙ্কজনক ঘটনার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে শিয়ালদা। হাজার হাজার অসহায় ,নিঃসম্বল মানুষ ট্রেন -বোঝাই হয়ে এসে নেমেছিলেন এই শিয়ালদা ষ্টেশনেই। চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাসে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল চারিদিক। শিয়ালদার প্লাটফর্ম থেকে তাঁরা কেউ গেছিলেন আত্মীয়ের বাড়ি, কেউ শরনার্থী শিবিরে ,কেউ বা অন্ধকারে। একটা রেল স্টেশন জীবনের কী  চরম বৈপরীত্যের সাক্ষী !


        নিত্যযাত্রীদের ছোটাছুটি , ভিক্ষুকদের পরিচর্যারত সাহেব-মেমের দল , পোরট্রেট আঁকায়  মগ্ন উঠতি  শিল্পী , ভিড়ের মাঝে একলা দুটি প্রেমিক-প্রেমিকা ,প্লাটফর্মে  বসা খবরের কাগজ বিক্রেতা ,পুজোর সময় ঢাকিদের জমায়েত -- সব নিয়ে শিয়ালদা স্টেশন জীবনের ক্যালাইডোস্কোপ।
   


এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে শিয়ালদা সাউথ স্টেশন 



     

        ভগিনী নিবেদিতার বাড়ি ,বাগবাজার 


        ১৬ বোসপাড়া  লেন ,বাগবাজার --- বাংলা তথা ভারতের নব জাগরণের অন্যতম ক্ষেত্র। এই বাড়িতে  ১৮৯৮ সালের ১৩ই নভেম্বর ভগিনী নিবেদিতা  মেয়েদের স্কুল চালু করেন। এখানে তিনি থাকতেনও।


       একে  'ম্লেচ্ছ' মহিলা, তার ওপর , মেয়েদের স্কুল খুলেছে।  কলকাতার মানুষ খড়্গহস্ত হয়ে  ওঠেন।  কিন্তু সিস্টার  দমে যান নি। শুরু হয় স্কুল। শ্রী শ্রী মা সারদা দেবী উদ্বোধন করে বলেছিলেন , " আমি প্রার্থনা করছি , যেন এই বিদ্যালয়ের ওপর জগন্মাতার  আশির্বাদ বর্ষিত হয়  এবং এখান থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত মেয়েরা যেন আদর্শ বালিকা হয়ে ওঠে। "


       একটি দুটি করে ছাত্রী সংখ্যা  বাড়তে থাকে।  মানুষ কুসংস্কার কাটিয়ে   বাড়ির মেয়েদের পাঠাতে থাকেন। কিছুদিন পরে ছাত্রীদের বোর্ডিংও চালু হয়। তখন পাড়ার লোকে বলত নিবেদিতার স্কুল। সিস্টার   নাম দিয়েছিলেন  The Ramkrishna  School  For Girls .বর্তমানে স্কুলটির অবস্থান পাল্টে গেছে। নামও হয়েছে নতুন  --- Ramkrishna  Sarada Mission Sister Nivedita Girls' School .


       ১৬ বোসপাড়া লেনের বাড়িতে কাজের সুত্রে বহু মনীষীর আগমন হয়েছে। ১৮৯৯এর জানুয়ারী মাসে রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর ও স্বামী বিবেকানন্দ এক চা-চক্রে এই বাড়িতে মিলিত হয়েছিলেন। শ্রী সারদা মা এই বাড়িতে থেকেছেন। 

     
      পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাড়িটি কিনে নিয়ে শ্রী সারদা মঠের হাতে তুলে দিয়েছেন । মঠের  তত্ত্বাবধানে এখন মেরামতির কাজ চলছে। কলকাতার মানুষ শিগগিরই এই ঐতিহাসিক ভবনে প্রবেশাধিকার পেতে চলেছেন। 




ভগিনী নিবেদিতার স্কুল ও বাড়ি 

    

        মায়ের বাড়ী ,বাগবাজার 


        মায়ের বাড়ী  বলতে শ্রী শ্রী সারদা মায়ের উদ্বোধন লেনের বাড়িকে  বোঝায়। সারদা মা  ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের সহধর্মিণী , আধ্যাত্মিক জগতের এক মহান সাধিকা, একজন সমাজ সংস্কারক , একজন দক্ষ প্রশাসক  এবং সবার উপরে, তিনি ' মা '। জাতি ,ধর্ম ,দেশ ,কাল নির্বিশেষে সকলের মা। 


        সারদা মা সারা জীবন মানুষকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। মেয়েদের লেখাপড়া শিখতে ও স্বাবলম্বী হতে প্রেরণা যুগিয়েছেন ; এমন কী ,তাড়াতাড়ি বিয়ে না দিয়ে স্কুলে ভর্তি করার পরামর্শ দিয়েছেন; জাত -পাত , ধর্মান্ধতাকে উপেক্ষা করেছেন ; দু হাতে রামকৃষ্ণ মিশনকে আগলে রেখেছেন ; সেজন্যে ,মহারাজরা মাকে 'সংঘ জননী ' আখ্যা দিয়েছেন। 


       উদ্বোধন লেনের বাড়ি মায়ের  দুটি যুগান্তকারী কাজের  সাক্ষী।  এই বাড়িতে তিনি বিদেশিনী ভক্তদের আপ্যায়ণ করতেন। তখন মেম সাহেবকে ছোঁয়ার ' অপরাধে ' হিন্দু মহিলাকে স্নান করে  ' শুদ্ধ ' হতে হত। অথচ , মা নির্দ্বিধায় ভগিনী  নিবেদিতা ,ভগিনী দেবমাতা ,বেটি লেগেট প্রমুখ বিদেশিনীকে দু হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করেছিলেন।  তাঁরা এই বাড়িতে আসতেন, মায়ের কাজ করতেন। কলকাতা শহর বিরক্তিতে  ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকত। 



       দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো দুঃসাহসিক।  এখন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সমাজের উঁচু তলায় বাস করেন। কিন্তু ১০০ বছর আগে ছবিটা একদম বিপরীত ছিল। তাঁরা ছিলেন সমাজে ব্রাত্য । অভিনেত্রীদের অবস্থা ছিল আরো করুণ। মানুষ তাঁদের ঘেন্না করত !  এর প্রতিবাদ করেছিলেন মা।  উদ্বোধন লেনের বাড়িতে নিয়মিত আসতেন তারাসুন্দরী দাসী ,তিনকড়ি দাসী প্রমুখ অভিনেত্রী। শুধু তাই নয় , তাঁরা খাওয়াদাওয়া করতেন, মাকে গান শোনাতেন, মা তাঁদের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করতেন। রক্ষণশীল সমাজ  এ সব দেখে রেগে আগুন হয়ে যেত , অবাকও  হত। আজ যে শিল্পীরা তাঁদের প্রাপ্য সম্মান পেয়েছেন , সে ব্যাপারে ঠাকুর ও মায়ের অবদান অনস্বীকার্য। 


        বাগবাজারে মায়ের বাড়ি শুধু ঠাকুর -মায়ের ভক্তদের নয়, প্রত্যেক মানুষের দ্রষ্টব্য স্থান। এটি সামাজিক বিপ্লবের এক পীঠস্থান। 





মায়ের  বাড়ি  (সবুজ গ্রিল )





        ট্রাম 

        
        ভারতবর্ষে প্রথম ট্রাম চলেছিল কলকাতায় ,১৮৭৩ সালে। এখন যেখানে শিয়ালদা স্টেশনের কার পার্কিং ,তখন  সেখানে ছিল ট্রাম ডিপো।  যেত আর্মেনিয়ান ঘাট অব্দি। 


        ১৯০২ সালে কলকাতার মুকুটে আরেকটি পালক যোগ হয়। এশিয়া  মহাদেশে  প্রথম ইলেকট্রিক ট্রাম চলল এসপ্লানেড থেকে খিদিরপুর পর্যন্ত।  বিদায় নিল ঘোড়ায়  টানা ট্রাম। ওই বছরেই এসপ্লানেড - কালীঘাট রুটেও ইলেকট্রিক ট্রাম চলতে শুরু করে। 


       ধীর গতির অভিযোগে ট্রাম তুলে দেওয়ার কথা হয়েছে।  বেড়েছে লোকসানের বোঝাও। কিন্তু কলকাতা  নতুন,পুরনো দুজনকেই সমান যত্নে আগলে রাখে।  তাই আজও কলকাতার বুকে ট্রাম চলে। নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ট্রাম বাঁচানোর।  কলকাতায় বেড়াতে এসে ট্রামে চড়া অবশ্য  কর্তব্য। এই যান দেশের আর কোনো শহরে নেই যে !



আধুনিক চেহারার ট্রাম  (ময়দান অঞ্চলে)



        বুদ্ধ মন্দির , ঢাকুরিয়া 


        ঢাকুরিয়া ব্রিজ আর লেকের  মাঝে যে বুদ্ধ মন্দিরটি আছে, সেটি কলকাতার একমাত্র জাপানি বুদ্ধ মন্দির। এর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল ১৯৩৫ এ। বাইরের সিংহ মূর্তি দুটি ধর্মের রক্ষকের প্রতীক। ঘন বসতিপূর্ণ অঞ্চলে মন্দিরটি শান্ত ,ভাবগম্ভীর পরিবেশ সৃষ্টি করে। 

















        রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ  কালচার ,গোল পার্ক  (সংক্ষেপে, কালচার )


        রামকৃষ্ণ মিশনের এই শাখাটি শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র। এর সৃষ্টি হয়েছিল ১৯৩৮-এ।  গোল পার্কের বাড়িতে স্থানান্তরিত হয় ১৯৬০-এ। 


        ইনডোলজি ,বেদান্ত ,সংস্কৃত সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে এখানে গবেষণা চলে। দেশ.বিদেশ থেকে গবেষকরা আসেন। তাঁদের থাকার ব্যবস্থাও আছে এখানে। এই শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্রটি কলকাতা ,যাদবপুর ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা স্বীকৃত।  কলকাতা শহরের অন্যতম সেরা ভাষা শিক্ষার স্কুল এই কালচারে অবস্থিত। ১৪টি বিদেশী ও ৫টি ভারতীয় ভাষা শেখান হয় এখানে। 


      কালচারের সাধারণ গ্রন্থাগারটি অসাধারণ। বইয়ের সংখ্যা ২ লক্ষ ৩০ হাজারের একটু বেশি !  কত ছেলে মেয়ে যে এই লাইব্রেরির দ্বারা উপকৃত  হয়েছে ,হিসেব নেই। 


      কলকাতার অন্যতম সেরা জলসা , বিশেষ করে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের , অনুষ্ঠিত হয় কালচারের অডিটোরিয়ামে।  এ ছাড়া, বিভিন্ন গুণী  মানুষ , মিশনের সন্ন্যাসী ,সন্ন্যাসিনী দের বক্তৃতা হয় নিয়মিত। 


        হাতের কাজ শেখানোর ব্যবস্থা আছে। প্রতিদিন এলাকার দুঃস্থ  বাচ্চাদের খাবার দেওয়া হয়। 


        বাড়িটি দেখলে মনেই হয় না, ভিতরে এ রকম কর্মযজ্ঞ চলছে। এত শান্ত ,সুস্থ পরিবেশ ... মন ভালো হয়ে যায়। 
   
রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার 




        সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়ি ,বড়িশা ( বেহালা )


      
        দক্ষিণ কলকাতা অপ্সরাদের মত। বয়েস  হয়েছে ঢের ,তবু সে নবীনা।  দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ১৭শ ,১৬শ শতাব্দীর স্পর্শ পাওয়া যায় আজও। বড়িশা এমনই  এক অঞ্চল। 


        বেহালার জমিদার  রায়চৌধুরীদের গোত্র ছিল সাবর্ণ।  সেই থেকে নাম হয়েছে সাবর্ণ  রয়চৌধুরী।  পরিবারের  অন্যতম কৃতী  পুরুষ ছিলেন লক্ষ্মীকান্ত রয়চৌধুরী।  তিনি ১৬০৮এ মান সিংহের কাছ থেকে ডিহি কলকাতা সহ ৯টি পরগনার সত্ব লাভ করেন। লক্ষ্মীকান্ত ১৬১০ এ বাড়িতে দুর্গাপূজা শুরু করেন। সেই পূজা আজও  অনুষ্ঠিত হয়। 


       ১৬৯৮তে জমিদার বিদ্যাধর রয়চৌধুরীর সঙ্গে জব চার্নকের জামাইয়ের এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে ব্রিটিশরা সাবর্ণদের জমিদারির উত্তর দিকের তিনটি এলাকা লিজ নেয়। সেখানে তারা অবাধে বসবাস ও ব্যবসা করার অধিকার পায়। বিদ্যাধর এই চুক্তি  নি।  কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বার্ষিক ৩০০০০ টাকার বিনিময়ে দিল্লির বাদশাহকে রাজি করিয়ে ফেলেছিল। ফলে বিদ্যাধরের আর কিছু করার ছিল না। তিনি চুক্তিতে সই করলেন । বড়িশার বাড়ির যে আটচালা কাছারী ঘরে এই সই সাবুদ হয়েছিল , সেটি  এখন নেই।  শুধু  তার থামগুলো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে আজও দাঁড়িয়ে আছে। পরিবারের প্রাচীনতম দুর্গাপূজাটি এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। লোকে বলে বড়  বাড়ির পূজা। 



বড়  বাড়ির পূজা  (সামনে সেই থাম গুলি )


দ্বাদশ শিব মন্দির, বড়িশা  ( প্রতিষ্ঠাতা সন্তোষ রায়চৌধুরী ১৮শ  শতাব্দী )

 


        মনোহর ডাকাতের কালী মন্দির 



       দেড়শ বছর আগে দক্ষিণ কলকাতার দোর্দণ্ডপ্রতাপ ডাকাত ছিলেন মনোহর। অধুনা কালিঘাট থেকে কসবা পর্যন্ত ছিল তার  'এলাকা '। জ্ঞানীরা বলেন, প্রত্যেক মানুষের ভিতর অনেক মানুষ বাস করে। মনোহরের  ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। মানুষের কাছে তিনি ছিলেন মূর্তিমান বিভীষিকা। আবার , তিনিই জলাশয় খনন, মন্দির নির্মাণ প্রভৃতি কল্যাণকর  কাজও  করতেন। এখন যেটি রাসবিহারী এভিনিউ , অতীতে সেই রাস্তার দুপাশে তিনি অনেক পুকুর কাটিয়েছিলেন। মনোহরের পুকুর থেকে মনোহরপুকুর অঞ্চলের নামকরণ হয়। ডাকাতের নামানুসারে রাস্তার নাম , কলকাতায় এমন ঘটনা বিরল। 



      ট্রায়াঙ্গুলার পার্কের কাছে পূর্ণদাস রোডে মনোহর ডাকাতের কালী মন্দির অবস্থিত। শোনা যায় , মনোহরের বসতবাড়িও  ছিল এই ভিটেতে। কলকাতার জনবহুল ,অভিজাত পল্লীতে এমন  পরিবেশ যে এখনও  আছে , না দেখলে বিশ্বাস হত না। রাস্তা থেকে ভেতরে গেলেই বিরাট উঠোন। মাঝখান দিয়ে পায়ে চলার পথ। দুপাশে নারকেল ,সুপুরি, আরো অনেক গাছ।  রয়েছে হাড়িকাঠও।  সন্ধেবেলায় গেলে কোনো গ্রামের মন্দিরে এসে পড়েছি বলে মনে হয়!


      মন্দিরটি জৌলুসহীন। কিন্তু মায়ের মূর্তিটি বৈশিষ্টপূর্ণ । স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ  ছোট্। ফুল ,মালায় সর্বাঙ্গ ঢাকা। তবে , সবচেয়ে বড়  বৈশিষ্ট মায়ের তীব্র চাহনি।  চোখদুটি ভোলা যায় না। 



ডাকাত কালী 

 

        দক্ষিণেশ্বর  ও শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব 


        মা কালীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাণী  রাসমণি গঙ্গার পূর্ব তীরে মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন। তৎকালীন বঙ্গসমাজ একজন কৈবর্ত নারীর এ হেন ' স্পর্ধায়' জ্বলে উঠলো ! কিন্তু রাণীমা ব্রাহ্মণদের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে নিজের লক্ষ্যপূরণে অবিচল রইলেন।  গঙ্গার পূর্ব তীরে দক্ষিণেশ্বর  গ্রামে কচ্ছপের পিঠের আকৃতির এক বিশাল জমি পাওয়া গেল। মালিক জন হেস্টি নামে  এক সাহেব। ওই জমিতেই বিরাট এক বাড়িতে তিনি থাকতেন। নাম কুঠিবাড়ি। রাণীমা ৪২ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে কুঠিবাড়ি সমেত ওই সাড়ে  ৫৪ বিঘা জমি কিনে নেন। সূচনা হলো ভারতীয় ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের। 


      ১৮৪৮ সালে মন্দির নির্মাণের  কাজ শুরু হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বিখ্যাত ঠিকাদার কোম্পানি ম্যাকিনটস  এন্ড বার্ন কে। কাজ শেষ হয় ১৮৫৪ তে। তখনকার দিনে ৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে  গড়ে ওঠে মন্দির, ঘাট,রাস্তা,নহবতখানা ,যাবতীয় সব কিছু। কিন্তু ব্রাহ্মণদের  চক্রান্তে সঙ্গে সঙ্গে মন্দির উদ্বোধন সম্ভব হয় নি। সব বাধা কাটিয়ে মায়ের মন্দিরের দরজা খুলল পরের বছর , ১৮৫৫র ৩১ মে। 


      ভবতারিণীর মন্দিরটি নবরত্ন মন্দির। বেলনাকার যে অংশগুলি মন্দিরের ছাদে খাড়া দন্ডায়মান থাকে, তাদের বলে রত্ন। ৯টি থাকলে সেই মন্দির নবরত্ন। মন্দিরের গর্ভগৃহে  বেনারসী ও অলংকারে সেজে মা একেবারে ' রাজমাতা ' হয়ে বিরাজ করছেন। হিন্দু ধর্মের রীতি অনুযায়ী গর্ভগৃহ থেকে  একটু দূরত্ব বজায় রেখে তৈরী হয়েছে নাটমণ্ডপ। 


    মায়ের মন্দিরের লাগোয়া  উত্তর দিকে রয়েছে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। মন্দিরের পশ্চিমদিকে এক বিরাট প্রাঙ্গণ ,যার পশ্চিম সীমানায় অবস্থিত ১২ টি শিবমন্দির। প্রত্যেকটি মন্দির বাংলার চালা স্থাপত্য রীতিতে তৈরী।  প্রাঙ্গণের উত্তর সীমানায় শ্রীরামকৃষ্ণদেবের ঘর। মায়ের মন্দিরের পুব দিকে গাজিপুকুর। জমি কেনার আগে থেকে এই পুকুরের পাড়ে  একটি মাজার ছিল।  রাণীমার  নির্দেশে তার কোনো ক্ষতি না করে মন্দিরের কাজ হয়। লোকে ওই জায়গাটিকে বলত গাজিপিরের থান বা গাজিতলা। রাণীমা  জায়গাটি পাকা করে  দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ঠাকুর ঐখানে গিয়েও  প্রার্থনা করতেন। 



মা ভবতারিণীর মন্দির 

           
      মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম  কোণে যে  নহবত্খানাটি  ছিল, তার  ওপরতলার ঘরে থাকতেন  ঠাকুরের মা চন্দ্রমণি দেবী। নিচের ঘরটি ছিল শ্রী শ্রী সারদা মায়ের।  ঘরের দৈর্ঘ্য ৭ ফুটের একটু বেশি  হবে।  তারই মধ্যে মা সংসার সাজিয়ে হাসিমুখে বাস করতেন। বাসন কোসন , তরিতরকারি ,মসলাপাতি,বটি ,জামাকাপড়,বিছানা ,সব থাকত ওই এক চিলতে ঘরে। মাঝে মাঝে ঠাকুরের জন্যে জীয়ল মাছ রাখা থাকত শিকেয়।  কোনো কোনো রাত্রে  লক্ষ্মী দি ,যোগেন মা বা গোলাপ মা মায়ের  সঙ্গে ওই ঘরেই থেকে যেতেন!  এই ঘরের কাছে বসে মা এলাকার জেলে-বৌদের সাথে গল্প করতেন ,তাদের সুখদুঃখের কথা শুনতেন, পরামর্শ দিতেন। আজ নহবত্খানা মায়ের স্পর্শে মন্দির হয়ে গেছে। সেখানে মায়ের নিত্যাপুজা। 


      নহবতের পূব দিকে কুঠিবাড়ি। ঠাকুর আগে নিজের মা ও ভাইপোকে নিয়ে এই বাড়িতে থাকতেন। ভাইপোর অকালমৃত্যুর পর তিনি চলে যান মন্দিরের ঘরে এবং চন্দ্রমণি দেবী নহবতে। রাণীমা দক্ষিণেশ্বরে এলে কুঠিবাড়িতে উঠতেন। 

  
     নহবতের উত্তরে ছিল ঘন জঙ্গল ,যা পঞ্চবটি নামে  পরিচিত। ঠাকুর ওইখানে বটের তলায় বসে সাধনা করতেন। গাছটি কয়েক বছর হলো মারা গেছে। পঞ্চমুন্ডির আসন যেখানে ছিল, সেই বেলতলাটি সংরক্ষণ করা হয়েছে।


    দক্ষিণেশ্বর বাংলার নবজাগরণের অন্যতম কেন্দ্র। মন্দির প্রতিষ্ঠা করে হিন্দুসমাজের অচলায়তনকে চরম আঘাত করেছিলেন রাণী রাসমণি। ঈশ্বর সকলের, এই সহজ কথাটি তিনি নিজের কাজের মধ্যে দিয়ে প্রচার করেছিলেন। এর জন্যে  যে লড়াই লড়তে হয়েছিল, তার শক্তি  যুগিয়েছিল রাণীমার ঈশ্বরপ্রেম। প্রকৃত ঈশ্বরপ্রেম।


    মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় যেমন লড়তে হয়েছিল, তেমনি গদাধরকে মায়ের পুরোহিতরূপে  নিয়োগ ও বহাল রাখার সময়ও রাণী  রাসমণিকে লড়তে হয়েছিল। গদাইয়ের যে কাজগুলিকে আর সবাই ' অনাচার ' বলে ভাবত , তিনি সেগুলিকে সত্যানুসন্ধান বলে চিনতে পেরেছিলেন। তাই গদাইকে  বাধা দেন নি।


    দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অনুকূল পরিবেশে গদাইয়ের  রূপান্তর ঘটল। প্রকাশিত হলেন শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।


    বারো বছর কঠোর সাধনার পরে রামকৃষ্ণদেব ইশ্বরলাভ করেন। অর্থাৎ, মন্দিরের মাতৃমূর্তি থেকে রক্তমাংসের মানুষ ,সকলের মধ্যে তিনি ইশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করতে পারলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ,

          " আমার প্রাণের  মানুষ আছে প্রাণে
             তাই হেরি তায়  সকলখানে "

'প্রানের মানুষের' সন্ধান  পেয়েছিলেন বলে রামকৃষ্ণদেবের কাছে নিয়ম-কানুন ,সামাজিক বিধিনিষেধ ,ধর্মীয় ভেদাভেদ তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। তিনি নিয়মিত মাজারে গিয়ে প্রার্থনা করতেন,মেথরের সঙ্গে আত্মীয়ের মত মিশতেন,ডাকাতদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে এনেছিলেন , পতিতা নারীকে মা বলে ডাকতেন। উচ্চ -নীচ , শিক্ষিত -অশিক্ষিত ,হিন্দু -মুসলিম ,সব মানুষ চমকে গেলেন। ভালবাসার টানে তারা ছুটে আসতে লাগলেন দক্ষিণেশ্বরে।


      ধর্ম ,আধ্যাত্মিকতা  প্রভৃতি বিষয়ের সহজবোধ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পন্ডিতরা হিমসিম খেয়ে যান। কিন্তু রামকৃষ্ণদেব দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনার উদাহরণ টেনে অনায়াসে সেসব ব্যাখ্যা করতেন। সাধারণ মানুষ আবিষ্ট হয়ে শুনত এবং  পন্ডিতরা মুগ্ধ বিস্ময়ে কুর্নিশ করতেন। বিদ্বজ্জনেরা বুঝলেন ,হিন্দু ধর্মের সংস্কারসাধনের ক্ষমতা রাখেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব।   সমাজের মানীজন এবং  ব্রাত্যজন ,সকলের শ্রদ্ধা,ভালবাসার পাত্র হয়ে উঠলেন তিনি।


     অশিক্ষা ,কুসংস্কার ও শোষণের দোষে দুষ্ট  উনিশ শতকের সমাজকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব শুদ্ধ করেছিলেন। মানুষকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলেন , নিজের এবং অন্যের ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছিলেন। ধর্ম ধারণ করে ,এই সত্যকে তিনি আবার মানুষের মনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যে আলো  শ্রীরামকৃষ্ণদেব জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিলেন ,তা আজও  জ্বলছে। পৃথিবীর সবখানে।
    'শুদ্র' নারী মন্দির  প্রতিষ্ঠা করলেন ,আর সেই  মন্দিরের 'অশিক্ষিত' পুরোহিত হিন্দু ধর্মকে বাঁচিয়ে দিয়ে  গেলেন।ইশ্বরের কী  লীলা !!!




        দেশপ্রিয় পার্ক 


        কলকাতা শহরের যে কটি প্রাচীন পার্ক আজও  মর্যাদাসহ বেঁচে আছে, দেশপ্রিয় পার্ক তাদের অন্যতম। শহরের যে অঞ্চলে এর অবস্থান, সেই অঞ্চলটি এই পার্কের পরিচয়ে পরিচিত। এখানকার বাসিন্দারা বলেন, "দেশপ্রিয় পার্কে থাকি।"  
       এমনই  এর খ্যাতির বহর। 

       ১৯৪৫ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকরা কারাগার থেকে মুক্তি পান।  ঐ বছরেই তাঁদের সংবর্ধনা জানানো হয়েছিল দেশপ্রিয় পার্কে। মেজর জেনারেল শাহ নওয়াজ খান,কর্নেল জি.এস. ধীলন,লেফটেনান্ট সায়গল,লক্ষ্মী স্বামীনাথন প্রমুখর উপস্থিতিতে পার্কের মাটিতে সেদিন চাঁদের হাট।


       আজ কিন্তু দেশপ্রিয় পার্ক রাজনীতির সীমানার বাইরে। রাজনৈতিক সভা এখানে হয় না বললেই চলে। পার্ক এখন খেলাধুলার জায়গা। কলকাতার বিখ্যাত টেনিস ক্লাব এখানেই অবস্থিত। ফুটবল ,ক্রিকেট তো আছেই।


        দেশপ্রিয় পার্ক দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্র-ও বটে। পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমানা বরাবর রয়েছে অজস্র দোকান। জামা কাপড়,বৈদ্যুতিন দ্রব্য,খাবারদাবার, কী  না পাওয়া যায় সেখানে। দেশপ্রিয় পার্ক শুধু বিনোদন বা দুর্গাপূজা নয় ,মানুষের রুজিরুটির জায়গা-ও  বটে।


        ' দেশপ্রিয় '  যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ছিলেন বিলেত ফেরত উকিল। দেশের কাজ করবেন বলে এক সময় ওকালতি ছেড়ে দিয়েছেন।  খেটে খাওয়া মানুষের ইউনিয়নের  নেতৃত্ব-ও দিয়েছেন। জেল খেটেছেন। জেলে বসেই শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেছেন।


         যতীন্দ্রমোহন সমাজের অভিজাত,বিদগ্ধ সম্প্রদায়  এবং দরিদ্র,নিপীড়িত সম্প্রদায়,উভয়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর নামাঙ্কিত পার্ক-ও তাঁর পথেই চলছে। দেশপ্রিয় পার্কে উচ্চবিত্তের ক্লাব আছে, সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা আছে ; মধ্যবিত্তের হকার্স কর্নার-ও আছে।




দেশপ্রিয় পার্কের একাংশ 



        

        করুণাময়ী কালী মন্দির , টালিগঞ্জ 


        অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ।  বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের নন্দদুলাল রায়চৌধুরীর ঘরে খুশির বান  ডেকেছে। তিন পুত্রের পর নন্দদুলাল-ঘরণী কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছেন। 
        পিতার নয়নমণি  হয়ে বেড়ে উঠতে লাগলো মেয়ে। নাম করুণা। 

        
        কিন্তু বিধি বাম।  কন্যাসুখ নন্দদুলালের ভাগ্যে ছিল না। অকালে মৃত্যু হলো করুণার। নন্দদুলাল উন্মাদপ্রায়। অবশেষে শোকসন্তপ্ত পিতার হৃদয় ঈশ্বরের চরণে এসে শান্ত হলো। গঙ্গার তীরে মা কালীর  মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন । নাম দিলেন করুণাময়ী কালী মন্দির। শোনা যায়, মেয়ের আদলে মায়ের মুখ গড়িয়েছিলেন নন্দদুলাল। মা কালীকে মা নয় , সন্তানরূপে দেখেছিলেন তিনি।


        মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৭৬০এ। তারপর পার হয়ে গেছে  তিনটে শতাব্দী।একটা সহস্রাব্দ-ও। সেদিনের গঙ্গা আজ শীর্ণকায়া আদি গঙ্গা হয়ে সরে গেছে খানিকটা দূরে। প্রাচীন নবরত্ন মন্দির আজ নেই। একই অবস্থানে যে নতুন মন্দির হয়েছে , তাতে চালা স্থাপত্য রীতি বিদ্যমান। এত পরিবর্তনের মাঝে করুণাময়ী মা কিন্তু একই আছেন। সদা হাস্যময়ী।


        করুণাময়ী মন্দিরের  মা কালী ও শিব ঠাকুরের মূর্তি একটিই  শিলাখণ্ড  থেকে তৈরী। একমাত্র এই মন্দিরে দেবাদিদেব মহাদেব কৃষ্ণাঙ্গ।  মা কালীর মুখ এমন ভাবে তৈরী, মনে হয় যেন  হাসছেন!  মাকে শাড়ি  পরানোর কায়দাটিও অভিনব।


        করুণাময়ী কালীমন্দির কলকাতার জনবহুল এলাকায় অবস্থিত একটি সুবিখ্যাত মন্দির। তবু এর ঘরোয়া পরিবেশটি বজায় আছে।  করুণাময়ী কালী যে নন্দদুলালের ঘরের মেয়ে ....


Add caption





Thursday, 2 April 2015

BANGARH

        Bangarh is now a hamlet situated near Gangarampur town in South Dinajpur district. Earlier it was known as Devkot, Ktivarsha & several other names. It came into existence in the times of the Mauryas. Till the end of medieval period the place continued to be the centre of art, education, business & power. It experienced the rule of who's who of Indian history --- Mauryas, Kusanas,Guptas, Palas, Senas & afghans.


        In the 30s' of 20th century excavation at Bangarh revealed the remains of a citadel. Use of bricks in its construction was a characteristic of the period of Kusanas.  Remains of the boundary are still there. The wall is multi-layered.  There is a chamber which was supposedly a granary.


        There is a beautiful tribal village nearby with neatly coloured huts. The village has a strange construction dating back to the Palas.  There are four stone-made pillars on the four corners of a square plot.  There is neither roof nor wall. Purpose of this construction is still unknown.


        Bangarh is now almost a forgotten place. For local people it's any other picnic spot.  Winter is the best time to visit. The sprawling mustard field makes Bangarh really beautiful. Local laal doi (red coloured curd) is a must-have.


        Bangarh can be reached by car from Balurghat which is 45 km away.


GRANARY

WALL

TRIBAL VILLAGE

PILLARS